ইউক্রেন যুদ্ধ পশ্চিমা দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করেছে

ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন এক মাস পেরিয়েছে। এই সময়ে রুশ সেনাদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে ফেলেছে ইউক্রেনীয় সেনারা। রাশিয়া আপাতদৃষ্টিতে ইউক্রেন যুদ্ধে এখনো বড় ধরনের কোনো সাফল্য পায়নি। কিন্তু মানবিক সংকট বেড়ে চলেছে। ৩৭ লাখের বেশি মানুষ ইউক্রেন ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিয়েছে। যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকট।
রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর পশ্চিমা দেশগুলো একের পর এক মস্কোর উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এ অবস্থায় ইউক্রেনকে আরো সমন্বিতভাবে সহায়তা ও পশ্চিমা দেশগুলোর নিরাপত্তা ইস্যুতে গত বৃহস্পতিবার ইইউ, জি-সেভেন ও ন্যাটোর জরুরি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এবারের সম্মেলনগুলোতে আলোচনায় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে আরো কড়া শাস্তি, ইউক্রেনের জন্য আরও সহায়তা এবং ইউরোপের দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা আরো জোরালো করার মতো বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে। বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর স্থায়ী সামরিক তৎপরতা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত হয়েছে। আপাতত রাশিয়ার আগ্রাসনের পরিপ্রেক্ষিতে ন্যাটোর মহাসচিব ইয়েন্স স্টলটেনবার্গ বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া ও স্লোভাকিয়ায় চারটি নতুন ‘ব্যাটল গ্রুপ’ মোতায়েনের ঘোষণা করেছেন।
তবে ইউক্রেনের দাবি মেনে সে দেশের উপর ‘নো ফ্লাই জোন’ কার্যকর করতে এখনো রাজি নয় ন্যাটো। কারণ সরাসরি রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক সংঘাত এখনো এড়িয়ে চলতে চায় ন্যাটো। তবে বাইডেনের আশঙ্কা, রাশিয়া রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করতে পারে। এমনকি পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছে না মস্কো। ফলে ন্যাটোকে শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার মোকাবিলা করতে হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেক বিশ্লেষক।
রাশিয়ার উপর আরো নিষেধাজ্ঞার প্রশ্নে পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের কিছুটা অভাব রয়েছে। বিশেষ করে গ্যাস ও পেট্রোলিয়ামের মতো জ্বালানি আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করার প্রশ্নে জার্মানির মতো দেশ এখনো এমন চরম পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত নয়। রাতারাতি এমন সিদ্ধান্ত নিলে জার্মানি তথা ইউরোপের অর্থনীতির মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা ওলাফ শলৎেসর সরকারের। ধাপে ধাপে সেই দিশায় অগ্রসর হতে চায় জার্মানি।
যদিও ইউক্রেন, যুক্তরাষ্ট্র ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো পুতিনের আয়ের গুরুত্বপূর্ণ এই উৎস বন্ধ করে দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। একমাত্র এভাবেই রাশিয়ার অর্থনীতিকে পুরোপুরি বিপর্যস্ত করে পুতিনের ক্ষমতা খর্ব করা সম্ভব বলে তারা মনে করে। স্পেন, পর্তুগাল, ইতালি ও গ্রিস জ্বালানির ক্ষেত্রে রাশিয়ার উপর নির্ভরতা কমাতে জরুরি ভিত্তিতে ইউরোপীয় স্তরে সমন্বয়ের মাধ্যমে পদক্ষেপ নেওয়ার পক্ষে।
এ অবস্থায় ইউরোপকে সহায়তা করতে এগিয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের উপস্থিতিতে ব্রাসেলসে হওয়া এক চুক্তির আওতায় এ বছরের শেষ নাগাদ যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় ইউনিয়নকে অতিরিক্ত ১ হাজার ৫০০ কোটি ঘন মিটার এলএনজি বা তরলীকৃত গ্যাস সরবরাহ করবে। বোঝাপড়া চূড়ান্ত হওয়ার পর এক সাংবাদিক সম্মেলনে বাইডেন বলেন, এ বছর ইউরোপে গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে যুক্তরাষ্ট্র সব রকম পদক্ষেপ নেবে।
ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডের লেইন যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেন, রাশিয়ার জ্বালানির ওপর নির্ভরতা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার চেষ্টা শুরু করেছে ইউরোপ। এ বছরের মধ্যে রুশ গ্যাসের ওপর নির্ভরতা দুই-তৃতীয়াংশ কমানোর টার্গেট নিয়েছে ইইউ।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জি-সেভেন ও ন্যাটোর মতো রাষ্ট্রজোটের প্রাসঙ্গিকতা ও ঐক্যের অভাব নিয়ে কিছুদিন আগে পর্যন্তও নানা সংশয় দেখা যেত, কিন্তু ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর নিন্দুকেরা পিছু হঠতে বাধ্য হচ্ছে। তিন রাষ্ট্রজোটই অভূতপূর্ব ঐক্য দেখিয়ে দ্রুত একের পর এক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে এবং আরো খারাপ পরিস্থিতির আশঙ্কায় প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। অ্যটলান্টিকের দুই প্রান্তের মধ্যে এই ঐক্য সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলের অনিশ্চয়তা দূর করতে পেরেছে। ন্যাটোর সম্মেলনের পর এক সাংবাদিক সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেন, ন্যাটো ও ইউরোপ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।

Exit mobile version