বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এত সুন্দর বই খুব কম লেখা হয়েছে

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ৯৮৩ লাইনের একটি দীর্ঘ কবিতা দিয়ে বই আগে লিখা হয়নি । সুন্দর, পরিপাটি  ছন্দের মাধ্যমে বঙ্গজয়ী বইটি লিখেছেন মোঃ সাজ্জাদ হোসেন , পেশাগত জীবনে একজন বস্র প্রকৌশলী ।অথচ কি চমৎকার তার লেখার হাত ! তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর জন্ম দিয়ে শুরু করেছেন এভাবে,

 ১৭ই মার্চ ১৯২০ জন্ম সাল, মাঝিহারা নায়ে হাল,

ঢাকিতে অকাল, জাগিল সকাল,

ফুটিল ফুল ,ছুটিল আকুল ঘ্রাণ,

তিনি বঙ্গজয়ী ,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ।

আহ ! কি অসাধারন ভাষার ব্যবহার । বঙ্গবন্ধু তার ছোট বেলায় দাদার ঘড় আর নানার ঘর পাশাপাশি থাকায় নানার ঘরে থাকতেন , বাবা তাকে প্রথম পড়ালেখা শেখান, বংশের প্রথম সন্তান হবার কারনে তিনি সবার আদর পেতেন , এই সবগুলো তথ্য নিয়ে কবি লিখলেন,

 নানার ঘরে থাকত নাতি, বাবার হাতেই জ্ঞানের বাতি,

বংশের প্রথম জ্যোতি,আদরটা তাই পেতেন অতি ।

এভাবেই বঙ্গবন্ধুর জীবনের শুরু থেকে জীবনী লিখতে শুরু করেন মোঃ সাজ্জাদ হোসেন , এরপর বঙ্গবন্ধুর জীবনের উল্লেখযোগ্য প্রায় প্রতিটি ঘটনা কবি লিখেছেন ইতিহাস আর তার আবেগের সংমিশ্রণে। কিশোর বয়সে অত্যন্ত সাহসী বঙ্গবন্ধু প্রতিটি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন। একবার তার সহপাঠী মালেককে হিন্দু মহাসভা সভাপতি সুরেন ধরে নিয়ে বেঁধে রাখে, এ কথা শুনে ছুটে যান বঙ্গবন্ধু, গিয়ে তিনি যা বলেন তা কবির ভাষায় ,

ওকে ছেড়ে দিতে হবে, নাহলে কেড়ে নিব

না নিয়া ফিরব না, প্রয়োজনে প্রাণ দিব !

এরপর মালেককে ফিরিয়ে আনে আমাদের বীর সন্তান , তবে এর জের টানতে হয় বেশ। তখন হিন্দু নেতারা বেশ ক্ষমতাবান ছিলেন , অনেক কে আসামী করে থানায় মামলা করেন, এই প্রথম জেলে যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ।

বঙ্গবন্ধুর জীবন আমাদের সবার মত সহজ ছিল না , তিনি তার সারা জীবন কাটিয়েছেন লড়াই সংগ্রাম করে , চেষ্টা করেছেন সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য। ১৯৪৩ সালে খুব ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয় , বঙ্গবন্ধু তার গুরু শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাহায্যে দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় যথাসাধ্য চেষ্টা করেন, দুর্ভিক্ষ ছিল খুব কঠিন , যেমনটি কবি লিখেছেন ,

 ‘মাগো একটু ফেন দেও, ক্ষুধার জ্বালায় যাচ্ছি মড়ি’

কর্তার ঘরেও ফেন নেই,তার ঘরেও শুন্য হাঁড়ি ।

এ যেন এক মহামারি ,শুন্য হাঁড়ি বাড়ি বাড়ি

পেট ধরে আছে পড়ে ,ক্ষুধার্ত নাড়ি!

কুকুর –মানুষ ডাস্টবিনে খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি !

সিভিল সাপ্লাই মন্ত্রী ছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ,তার সহায়তায় লঙ্গরখানা খুলে নিজে ঢেলা গাড়ি ঠেলে অনাহারীর মুখে খাবার পৌছে দিয়েছেন আমাদের বঙ্গজয়ী ।

তিনি হিন্দু মুসলিম ভেদ করতেন না , তিনি মানুষের মর্যাদা রক্ষার লড়াই করেছেন ,জাতপাতের দোহাই তার কাছে চলত না , তিনি সকল মানুষকে ভালোবাসতেন ,কবি সাজ্জাদ লিখলেন বঙ্গবন্ধুর কথা ,

 হিন্দু মুসলিম করছ লাড়াই ?

কে ভালো কে মন্দের বড়াই ?

আসো চোখের পর্দা সরাই,

আমরা কেন জাতকে ডরাই ?

জাত নিয়ে কেন স্বপ্ন হারাই?

ভুল পথে কেন নিজেকে জড়াই ?

এভাবেই সবাইকে ডেকে তিনি বোঝাতেন , তিনি চাইতেন যাতে করে কোন ভাবেই দাঙ্গা না লাগে । ১৯৪৭ সালে দাঙ্গার ভয়াবহ সময় চলছিল , বঙ্গজয়ী তখনো দাঙ্গা থামাতে দৃঢচেতা,  এর মধ্যেই সেপ্টেম্বরের ২৮ তারিখ প্রথম সন্তান কোল আলোকিত করে আসলো , কবি লিখলেন ,

 পরের মাসের ২৮ তারিখ কোল আলোকিত করে আসে প্রথম সন্তান শেখ হাসিনা,

এ যেন অন্ধকারে আলোর রেখা, দূর আকাশে চাঁদের দেখা ,বীরের ঘরে স্বপ্নসেনা ।

কবি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখেছেন নানা বিশেষণ ,চেষ্টা করেছেন সঠিক ইতিহাস মেনে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে ,

মুজিব তুমই বসন্তের শুকতারা, তুমি ফাগুনের বাতায়ন,

তুমি মেঘের ভেলায় গড়া এক স্বপ্ন স্মরণ ।

অন্যায়ের প্রতিবাদ করা আর জেল খাটা যেন তার জীবনের নিয়মিত রুটিন হয়ে গিয়েছিল , একদিন জেলগেটের স্মৃতি নিয়ে কবি লিখলেন,

 গিয়ে দেখেন স্ত্রী, বাবা,মা ,মেয়ে হাসিনা , ছেলে কামাল,

মেয়ে গলায় জড়িয়ে ধরেছে , নিজেকে দেয়া যায়না সামাল !

দারুণ ছন্দের ব্যাবহার করে কবি মোঃ সাজ্জাদ হোসেন আমাদের মহাবীরের জীবনের প্রতিটি ঘটনা জীবন্ত করেছেন নানা উপমায়। ভাষার জন্য আমরণ অনশন কিংবা দেশের জন্য বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়ানো কোন কিছুই বাদ যায়নি কবির কলম থেকে। ৫৪ সালের নির্বাচনের সময় বঙ্গবন্ধু যখন সারাদেশ চষে বেড়াচ্ছেন তখন একটি ঘটনা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা যাচাই করা যায় , এক বৃদ্ধা রাস্তার পাশে বঙ্গবন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছিলেন , তাকে পেয়ে হাত ধরে বাড়ির ভিতর নিয়ে গেলেন, বাকিটা কবির ভাষায়,

‘’ অনেক লোক সাথে ,বসতে দিলেন পাটি পেতে।

বৃদ্ধা এক বাটি দুধ দিলেন বঙ্গজয়ীকে খেতে ।

 আর চার আনা পয়সা হাতে-

এই আমার দোয়া, আর কিছু নেই সাথে ! ‘’

 আহ ! কি আবেগ আর ভালোবাসা যে আমাদের মহাবীরের জন্য ছিল সাধারণ মানুষের মনে !কবি লিখেছেন যতার্থই,

কেঁদে ফেলেন বঙ্গজয়ী,চোখে জল ,বাড়ে সাহস বাড়ে বল ,

বৃদ্ধা বলেঃ নাও , এ গরিবের দোয়া ,জিতবে তোমার দল ।

নানা সংকট, সংশয় , জেল জুলুম আর দেশের মানুষের জন্য তার আত্নদানের মধ্য দিয়ে চলে আসে ১৯৭১ সালের সেই মাহাকাব্যিক দিন , ৭ই মার্চ , কবি লিখেছেন,

 মহাকাব্য সঁপলেন এ জাতির চরণতলে ,

 আজও শুনে অবাক হই নয়নজলে !

কবি কাব্য বলতে থাকেন জনসমুদ্রসঙ্গে

 সে ভাষায় স্বাধীনতার কম্পন উঠে লক্ষ রক্ত তরঙ্গে !

তার এই ভাষণ কিভাবে বাঙালি জাতিকে এক সুতায় বেঁধেছিল তা আমরা জানি , এ দিনের এই ভাষণ ই ছিল মূলত সরাসরি কিন্তু কৌশলে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা , কারন পাকিস্থানি কর্তৃপক্ষ তখন চেষ্টায় ছিল পৃথিবীর কাছে বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে তুলে ধরার, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর দক্ষ রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কারনে পাকিরা সফল হয় নাই । ভূট্টো ,ইয়াহিয়া আর বঙ্গবন্ধুর বৈঠক ব্যার্থ হবার পর ২৫ই মার্চের কালো রাত্রি নেমে আসে মুক্তিকামী সরল নিরস্ত্র বাঙালীদের জীবনে,

এক ধ্বংসযজ্ঞ এক সভ্যতা বিনাশ,

 হায়েনার মানব রক্তে হোলির উল্লাস,

হঠাৎ হায়েনার রূপ পৈচাশ,

রক্ত রঞ্জিত দেহের শেষ নিশ্বাস,

মায়ের কান্না ভায়ের কান্না ,কান্না শত বোনের ,

 শত ধর্ষণ আর কান্না শত খুনের ।

 এরপর বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের বীর সন্তানদের রক্ত বিলিয়ে দেবার ইতিহাস, মুজিবনগর সরকার, বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী সাজিয়ে মৃত্যুদণ্ডের চেষ্টা , রাজাকার আলবদরদের ঘৃণ্য কর্মকান্ড ,৩০ লক্ষ শহীদের আত্নদানের শেষে কাঙ্খিত স্বাধীনতা কোন কিছুই কবি বাদ দেননি , লিখে গেছেন ছন্দের জাতুকরি ক্ষমতায় ।

 বীরাঙ্গনার চোখে জল

 সব হারিয়েও বুকে বল ।

 সবুজ বনে আলোর রেখা

পাতার বুকে সূর্য আঁকা ।

সোনালী আঁশের মা তুমি,

 বাংলাদেশ আজ স্বাধীন ভূমি !

এরপর১৯৭২ সালের ১২ ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেবার পর রাত দিন এক করে কাজ করে গেছেন দেশ পুনর্ঘঠনে। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে আমাদের মত হতভাগা আর অকৃতজ্ঞ জাতি আর এক টাও নেই । যে মানুষটা তার জীবন যৌবণ সব বিসর্জন দিল দেশের মানুষের জন্য আমরা তাকেই হারালাম এমন ঘৃণ্যভাবে! একটা যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের জন্য মাত্র তিন বছর কি যথেষ্ট? উন্মাদ ঘতকদের জন্য জাতি তার বীর সন্তানকে এভাবে হারালো !

১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫ সাল

 কেঁদে যাবে মহাকাল !

 হায়েনার রূপ দাজ্জাল !

 হত্যায় মাতাল হারে হাল !

 রক্ত নেশার ঘৃণ্য তাল …

ঘাতকের ঘুলি কেড়ে নিল বঙ্গজয়ীর প্রাণ !

লুটায়ে পড়ে দেহ, রক্তাত্ব স্বাধীনতার সম্মান !

শেখ হাসিনা শেখ রেহানা খোদার মেহেরবান ,

 বাইরে থেকে বেঁচে গেল আশার দুটি প্রাণ ।

এই মর্মান্তিক ঘটনার  মধ্য দিয়ে বইটি শেষ হয়, তবে কবির প্রতিটি লাইন আমার এত ভালো লেগেছে যে , মনে হচ্ছিলো সবগুলো লাইন লিখে দেই , সম্ভব হল না । আমাদের সূর্য সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে এমন বীরগাথাঁ লিখার জন্য কবি মোঃ সাজ্জাদ হোসেনকে অনেক ধন্যবাদ ,গভীর শ্রদ্ধা । ২০১৭ সালের বই মেলায় স্বপ্নলোক প্রকাশনা থেকে বইটি প্রকাশ হয়।

Exit mobile version